কৌশিকী অমাবস্যায় তারাপীঠে শক্তি মায়ের আরাধনা। পাচঁ সতীপীঠে ভক্তদের ভিড়।

কৌশিকী অমাবস্যায় তারাপীঠে শক্তি মায়ের আরাধনা। পাচঁ সতীপীঠে ভক্তদের ভিড়।
কৌশিকী অমাবস্যায় তারাপীঠে শক্তি মায়ের আরাধনা। পাচঁ সতীপীঠে ভক্তদের ভিড়।
কৌশিকী অমাবস্যায় তারাপীঠে শক্তি মায়ের আরাধনা। পাচঁ সতীপীঠে ভক্তদের ভিড়।
সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়: কৌশিকী অমাবস্যা তিথিতে তারাপীঠে প্রতিবছর বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয়। বিগত দেড় দশকে এই কৌশিকী অমাবস্যায় কার্যত বাঁধ ভাঙা মানুষের ভিড় হয় তারাপীঠে। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ পর্যন্ত আসেন পুজো দিতে। তারাপীঠ মহাশ্মশানে দূর দূরান্ত থেকে ভিড় করেন তন্ত্রসাধকররা। তাঁদের দেখতে ভিড় করেন ভক্তরা। সব মিলিয়ে কৌশিকী অমাবস্যার রাত তারাপীঠে একদম অন্যরকম। তবে এর মাহাত্ম্য জানলে শিহরিত হবেন যে-কেউ ! তারাপীঠ এই দিন হয়ে ওঠে তন্ত্রসাধনার কেন্দ্র। বহু তান্ত্রিকরা এই দিনটিকেই বাছেন সাধনা সিদ্ধির জন্য । কিন্তু কেন, কী লুকিয়ে আছে এই তিথিতে ?
হিন্দু তন্ত্রমতে, এই তিথিতে কঠোর তপস্যায় আশাতীত ফল মেলে। সাধক কুলকুণ্ডলিনী চক্রকে জয় করতে পারে। আবার এই তিথিতেই সাধনা করেন বৌদ্ধ তান্ত্রিকরাও।  তন্ত্র মতে এই রাতকে 'তারা রাত্রি'ও বলা হয়৷ তান্ত্রিকরা মনে করেন, এক বিশেষ মুহূর্তে স্বর্গ ও নরক দুইয়ের দরজা মুহূর্তের জন্য খুলে যায় এদিন।  সাধক নিজের ইচ্ছা মতো ধনাত্মক অথবা ঋণাত্মক শক্তি সাধনার মধ্যে আত্মস্থ করেন ও সিদ্ধি লাভ করেন ৷ তাই এই রাত কঠিন তপস্যার দিন। সাধনার লক্ষ্যপূরণের দিন। কৌশিকী অমাবস্যা, অন্য সব অমাবস্যার থেকে একটু আলাদা। তন্ত্র ও শাস্ত্র মতে, ভাদ্র মাসের এই তিথিতে অনেক কঠিন সাধনায় সিদ্ধিলাভ করা সম্ভব।
কথিত আছে, এই তিথিতেই তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করেন সাধক বামাখ্যাপা। তারাপীঠ মহাশ্মশানের শ্বেত শিমূল গাছের নিচে বসে সাধনা করেছিলেন সাধক বামদেব। মায়ের একনিষ্ঠ ভক্তকে নিরাশ করেননি মা তারা। দেখা দেন বামদেবকে। তাই ভক্তদের ধারণা, এদিন মা-কে ডাকলে তিনি সাড়া দেন, খালি হাতে ফেরান না।  তাই তো এত ভিড় হয় দেবী দর্শনের জন্য । 
কৌশিকী শব্দের আভিধানিক অর্থ, আদ্যাশক্তির রূপ বিশেষ। পুরাণ মতে, কৌশিকী রূপেই শুম্ভ নিশুম্ভকে বধ করেছিলেন আদ্যাশক্তি। তাই এই দিনটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয় তারাপীঠে। 
কৌশিকী অমাবস্যায় তারাপীঠে মায়ের ভোগের রীতি কেমন হয়, কোন বিশেষ পদ দেওয়া হয় মাকে এই কৌশিকী অমাবস্যার দিনে জেনে নিন এখান থেকে।
কৌশিকী অমাবস্যার দিন বীরভূমে মা তারার মন্দিরে বিশেষ পুজো করা হয়। ভাদ্র মাসের এই অমাবস্যা খুব বিশেষ। এই দিন তন্ত্র মতে ও শাস্ত্র মতে উভয় পদ্ধতিতেই রীতি মেনে মা তারা পুজো করা হয়। কৌশিকী অমাবস্যা সাধনার জন্য খুব বিশেষ। এই দিন সাধনা করলে ভক্তরা বিশেষ ফল লাভ করে।
হিন্দু শাস্ত্র মতে এই তিথি খুব বিশেষ। তারাপীঠে এই দিন মায়ের বিশেষ পুজো করা হয়। এই দিন মাকে, আতপ চাল, নারকেল, ১০৮ টি জবা ফুল, ঘিয়ের প্রদীপ ও ঘি নিবেদন করা হয়।
অনেকে এই তিথিতে নিজের বাড়িতেও কালী পুজো করে থাকেন। এই তিথির মাহাত্ম্য অনুসারে, মায়ের সামনে অবিরত একটি ঘি এর প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখার নিয়ম রয়েছে। এই প্রদীপ যেন কোনোভাবেই নিভে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
শুধু হিন্দু শাস্ত্র নয় বৌদ্ধ শাস্ত্র মতেও এই অমাবস্যার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এই আমাবস্যায় তারা মায়ের সঙ্গে বামাক্ষ্যাপার ও বিশেষ পুজো করা হয়ে থাকে তারাপিঠে। অমাবস্যায় খাঁড়া ও কুশ কাটা ব্যবহার করার রীতি রয়েছে। রীতি অনুসারে এই দিন মাকে পাঁচ রকমের ফল মিষ্টির ভোগ দেয়া হয়। সারারাত ধরে জেগে চলে মায়ের পুজো ও তন্ত্র সাধনা। 
তারাপীঠের ভোগে এই দিন বিশেষ পদ হিসাবে থাকে শোল মাছ পোড়া, সঙ্গে থাকে ভাত বা পোলাও, পাঁচ রকমের ভাজা, মিষ্টি, শাক, পায়েস ইত্যাদি। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামে দুই শক্তিশালী অসুরকে বধ করার জন্যই দেবী কৌশিকীর আবির্ভাব হয়।
তারাপীঠের মতোই বোলপুরের কঙ্কালীতলা সতীপীঠও অমাবস্যার বিশেষ তিথি কৌশিকী অমাবস্যাকে ঘিরে সেজে উঠেছে। এই বিশেষ অমাবস্যার দিনটিতে কঙ্কালীতলায় আসতে শুরু করেন দূর-দূরান্তের ভক্ত থেকে শুরু করে সাধু-সন্ন্যাসীরা। আজকের দিনের জন্য স্থানীয় কঙ্কালীতলা পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে মন্দির সংলগ্ন চত্বর বিভিন্ন লাইট দিয়ে নতুনভাবে সাজিয়ে তোলা হয়েছে।
মন্দির চত্বরে ও পার্শ্ববর্তী জায়গায় পরিচ্ছন্নতার উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও ভক্তদের সুবিধার্থে ভোগ খাওয়ার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভাদ্র মাসের শুরুতেই যে অমাবস্যা, সেটাই কৌশিকী অমাবস্যা নামে পরিচিত। এই পুজোর সঙ্গে জড়িত আছে নানা পৌরাণিক কাহিনি। কৌশিকী অমাবস্যার পবিত্র লগ্নে তারাপীঠের মন্দিরের ন্যায় কঙ্কালী মন্দিরেও বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয়। কথিত আছে সাধক বামাক্ষ্যাপা, ১২৭৪ বঙ্গাব্দে কৌশিকী অমাবস্যায় তারাপীঠ মহাশ্মশানে শ্বেতশিমূল বৃক্ষের তলায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। মা তাঁকে নিরাশা করেনি। ধ্যানমগ্ন বামাক্ষ্যাপা এদিন তারা মায়ের আবির্ভাব পান। এছাড়াও শোনা যায়, এই তিথিতে কৌশিকী রূপে মা তারা বিশেষ সন্ধিক্ষণে, শুম্ভ- নিশুম্ভ নামক অসুরদের দমন করেছিলেন। সেই নাম থেকেই 'কৌশিকী অমাবস্যা' নামটি এসেছে।
আবার আজকের এই দিনে দশ মহাবিদ্যার দ্বিতীয়া স্তরের অন্যতম দেবী ‘তারা’ মর্ত ধামে আবির্ভূত হন।গত দুবছর অতিমারির কারণে পুণ্যার্থীরা এই তিথিতে আসতে পারেননি কঙ্কালী তলায় ৷ এ বছর আবার আগের মতোই মন্দির চত্বরে ভক্ত সমাগম। তাই জাকজমকপূর্ণ ভাবে কৌশিকী অমাবস্যার পুজোর আয়োজন হয়েছে কঙ্কালী তলায়। আবার আগের মত এই বিশেষ দিনে মাকে দর্শন করতে পেরে খুশি ভক্তরাও।