এমব্রয়ডারি : আরামবাগের অর্থনীতি চাঙ্গা করেছে
সূঁচ আর রঙিন সুতো আরামবাগ মহকুমার অধিকাংশ গ্রামের জীবনধারা বদলে দিয়েছে। চাঙ্গা করেছে অর্থনীতি। খানাকুল, ঘোষপুর,খামারগোড়ী, নারায়ণপুর , মলয়পুর , মায়াপুর, ধামসা, মুথাডাঙ্গা, বাঁচানোর , খুশিগঞ্জ, গোঘাট, বেঙ্গাই, পুরশুড়া, ঘোলদিগরুই ইত্যাদি এলাকার কয়েক হাজার পরিবার এখন কাপড়ের ওপর এমব্রয়ডারির কাজ করে চলেছেন। কাপড়ের ওপর নকশা বুনতে বুনতে নিজেদের জীবন থেকে দারিদ্রের ছবি মুছে ফেলতে চায় তাঁরা। তবু মহাজন নির্ভর এই ব্যবসায় লাভের গুড় ওদের ভাগে জোটে সামান্যই। বাজারও সারাবছর ভাল যায় না। তাই সূচী শিল্পকে আঁকড়ে ধরে এলাকার বেকার যুবকেরা যখন সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন তখন একরাশ সমস্যা তাদের নিরাশ করে তুলেছে। জরি আর এমব্রয়ডারির কাজে হাওড়া জেলার উলুবেড়িয়া অঞ্চলের দীর্ঘদিন ধরে সুনাম। হাতের কাজ আর অভিজ্ঞতার নিরিখে সেই খ্যাতি আজ বহুদূর প্রসারিত হয়েছে। তবু আরামবাগ অঞ্চলের নতুন করে উঠে আসা এই শিল্পী ও ব্যবসায়ীরা ইতিমধ্যেই কাজের গুণে বাজারে সুনাম তৈরি করতে শুরু করেছেন। আরামবাগ ব্লকের মুথাডাঙার মোড়ে গত কয়েকবছরে বেশ কয়েকটি এমব্রয়ডারি কাজের দোকান গড়ে উঠেছে। বর্ধমান-মুথাডাঙা রাস্তার পাশে সারি সারি দোকান ঘর। এদের কেউ সুতি কেউবা রেশম সুতো আর জরি দিয়ে শাড়ি, সালোয়ারের ওপর অপূর্ব নকশা বুনে চলেছে। এমনই এক শিল্পী হলেন শেখ শরিফুল। তার দোকানের ভেতর ঢুকে দেখা গেল একটা কাপড় খুলে চারদিকে টান টান করে বাঁধা আছে। শরিফুল জানালেন, শাল কাঠদিয়ে তৈরি 'আড্ডা' আর 'সামসারা'র ওপর কাপড় ফেলে টান টান করে বাঁধা হয়। - তারপর সুঁচে সুতো লাগিয়ে কাপড়ের ওপর নকশা ফুটিয়ে তোলেন। তবে তারও আগে নকশা করা কাগজ শাড়ির ওপর ফেলে নকশা এঁকে নিতে হয়। এক একটা শাড়ি বুনতে তিন থেকে চারজনের মতো শিল্পীর প্রয়োজন হয়। মহাজনের কাছ থেকে কাপড় আর সুতো নিয়ে ওরা কাজ করছেন। তাছাড়া কেউ শাড়ি দিয়ে গিয়ে নকশা পছন্দ করে দিলেও সে শাড়িতেও তাঁরা নকশা করে দেন বলে জানালেন। খানাকুলের ছেলে শেখ আসরাফুল কালো রঙের একটা শাড়ির ওপর রেশম সুতোর নকশা তুলতে তুলতে জানাল, এলাকার একটা বড় অংশের মানুষ এখন এমব্রয়ডারি শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। দারিদ্রের হাত থেকে বাঁচবার পথ খুঁজতেই শৈশব পার হতে না হতে আরামবাগের বিভিন্ন গ্রামের ছেলেরা এই শিল্পে চলে আসছেন। শাড়িতে সাধারণ সুতোর যেন নকশার চল আছে তেমনি জরি, চুমকির কাজেরও বেশ চাহিদা আছে। মুথাডাঙা, ঘোষপুর, রামনগর, হরিণখোলা ও গড়েরঘাটের বেশ কয়েকটি গ্রামে এখন এমব্রয়ডারিকে কেন্দ্র করে জেলার এক নতুন অর্থনীতি গড়ে উঠছে। খানাকুলের হারণ শেখ, ঘোষপুরের জাহির, শেখ রফিকেরা আজ এলাকায় এই শিল্পে যথেষ্ট নাম করে ফেলেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁরা স্বীকার করে নিয়েছেন, হাওড়া থেকেই এমব্রয়ডারির কাজ এই জেলায় এসেছে। শিল্পীরা জানিয়েছেন, অল্প পুঁজি নিয়েও এই শিল্পে নামা যায়। শাল কাঠে সামসারা ও আড্ডার দাম ১২০০ টাকার মতো। এরসঙ্গে একশ টাকার সুতো আর চুমকি, জরি কিনে নিলে একটা শাড়ি বোনা যাবে। তবে এমব্রয়ডারি কাজের মূল সম্পদ হল শিল্পীর চোখ আর ধৈর্য্য। মুথাভাঙার শিল্পী শেখ রিজাউল ও পলাশ মালিক বলেন, একটা শাড়ি বুনতে তিন থেকে দশজনের মতো লোক লাগে। সবই নির্ভর করে শাড়ির কাজের ওপর। নকশা বোনার মজুরিও কাজের ওপরই নির্ভর করে। শাড়ি পিছু পাঁচশো থেকে দুই, তিন হাজার টাকা পর্যন্ত তাঁরা মজুরি নেন। কলকাতার বড়বাজার থেকেই শিল্পীরা শাড়ি নিয়ে আসেন। জর্জেট থেকে বেনারসী সব রকম শাড়ির ওপর এমন সুতোর কাজ হচ্ছে। শাড়ির ওপর সুতো বুনতে বুনতে যে শিল্পীদের নিজেদের জীবনেও রং ধরেছে তাদের কথাতে সে ইঙ্গিত পাওয়া গেল। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করে মাসের শেষে হাতে দু, আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত আসছে। তাই মুথাডাঙায় কয়েক বছর আগে যেখানে তিনটের মতো কাজ হত আজ সেখানে ৫০ টার মতো জায়গায় কাজ হচ্ছে। শুধু মুথাডাঙাতেই ২০০ ওপর পরিবার আজ প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে আছে। একইভাবে খানাকুল, ঘোষপুর, গড়েরঘাট, হরিণখোলাতে দিন দিন এই কাজে লোকের সংখ্যা বাড়ছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মেশিনেও এমব্রয়ডারির কাজ চালু হয়েছে। কিন্তু তা হাতের কাজের সঙ্গে পেরে উঠতে পারেনি। গুণমানের কাজ বাছতে গিয়ে শিল্প রসিকেরা হাতে বোনা কাজই পছন্দ র করছেন। বাজারও আগের তুলনায় ভাল। তবু ওরা খুশী নয়। কারণ বছরের ছ'টা মাস এই কাজের যেমন ভীষণ চাহিদা থাকে তেমনি বছরের অন্যান্য মাসগুলো বলতে গেলে শুকনো যায়। বরং সারাবছর বাজার একই ভাবে না পাওয়ার জন্য প্রচণ্ড সম্ভাবনা নিয়েও আজ এই শিল্প ধুঁকছে। শিল্পীদের আবেদন, স্থানীয় প্রশাসন একটু উদ্যোগী হয়ে আরামবাগে এই শিল্পের বেচা-কেনার জন্য কোনও কেন্দ্র করে দিলে অদূর ভবিষ্যতে এলাকার অর্থনীতি এমব্রয়ডারিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠবে।