পড়ুয়াদের আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে

পড়ুয়াদের আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে

শুভশ্রী আকুলী: ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে...’ প্রচলিত এক ছড়া। ছেলেবেলা থেকেই শুনে আসা ছোট্ট ছড়াটা গুরুজনেরা খুবই ব্যবহার করেন পড়ায় ফাঁকি দিতে দেখলেই। লাইন দু’টি হলেও, এর ব্যাপ্তি বিশাল। কারণ ছেলেবেলা থেকে শুরুও হত ‘গাড়ি-ঘোড়া’ চড়ার রেষারেষি। সেই দৌড়ে না নামলে যে বিপদ। পড়াশুনোয় ফাঁকি মানেই ব্যঙ্গ সুর ভেসে আসতে পারে, তাই অপেক্ষা না করাটাই শ্রেয়। আর সেই ইঁদুর দৌড়ে সামিল হতে গিয়ে অনেক পড়ুয়াকে দূরে সরে যেতে হয়েছে নিজের পছ¨ের বিষয় থেকে। গান গাওয়ার খুব সখ ছিল দশ বছরের সঙ্গীতার। খোলা গলায় তার গান শুনে কত মানুষ যে বাহবা দিয়েছে তার ইয়াত্তা নেই। আট বছরের স্বরূপের আঁকা ‘রবীন্দ্রনাথ’ দেখে ßুñলের শিক্ষকরা হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। সঙ্গীতা-স্বরূপ এখন গান, আঁকা ভুলে গিয়েছে। কারণ গুরুজনেরা চাননি। তাঁরা চেয়েছেন, সন্তান শুধু পড়াশুনো করুক। পরীক্ষায় প্রত্যাশিত ফল আসে না। শুরু হয়ে যায় গুরুজনদের ভর্ৎসনা। হতাশার অতলে তলিয়ে যেতে থাকে পড়ুয়ারা।

আত্মহত্যা। আত্মহত্যাকেই এখন একমাত্র পথ হিসেবে বেছে নিচ্ছে বহু পড়ুয়া। দৌড়ে পিছিয়ে পড়লে উঠে না দাঁড়িয়ে তারা বলি দিচ্ছেন নিজেদের। কিন্তু কেন? এর জন্য কি শুধুই জীবনের লক্ষ্যে হেরে যাওয়াটা দায়ী?  মনস্তাত্বিকদের মতে, এর পেছনে জড়িয়ে আছে অনেক কারণ, অনেক অতীত। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ  হল পরিবারের ভুূমিকা, সেটা ভাল রেজাল্টের ক্ষেত্রেই হোক কিংবা আত্মহত্যার মত সিদ্ধান্তে। ছোটরা মা-বাবাকেই বট গাছ ভেবে আঁকড়ে জড়িয়ে থাকার চেষ্টা করে। তাদের ছোটখাটো প্রতিক্রিয়া ছোটদের মনে বড় আঘাত ফেলে। খারাপ রেজাল্টে বাবা-মায়ের বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে, পারিপার্শ্বিকতার কথা ভেবে অপমানের ভয় উঠে আসে। পড়ুয়ারা নিজেদের তখন খুব অসহায় মনে করে, ভাবে অনেক বড় দোষী সে।

মনবিশেষজ্ঞ নীলাঞ্জনা ব¨্যােপাধ্যায়ের মতে, ছোটবেলা থেকে হাতের সামনে সব পেয়ে যাওয়া ও ভার্চুয়াল জগতের কারণে ধৈর্যশক্তি প্রবলভাবে কমে এসেছে তরুণ প্রজন্মের। ফলে ব্যর্থতা থেকে উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। সঙ্গে বাস্তব জীবনে যোগাযোগের মাধ্যম ছোট হয়ে পড়েছে। একান্নবর্তী পরিবারের বদলে সবাই এখন ছোট পরিবারে বেশি আগ্রহী। ßুñল, প্রাইভেট টিউশনেই নিজেদের সীমাবদ্ধ করতে বাধ্য হচেছ পড়ুয়ারা। বাস্তবকে দেখছে কম, জানছে কম। তাদের শিশুকাল থেকেই বোঝানো হয়, পড়াশোনা করে প্রতিষ্ঠিত হওয়া দরকার। তবে তাদের বোঝানোর মধ্যে আবেগ থাকে না, থাকে জোর খাটানো। ছোটদের ভাল লাগা বিষয়গুলিতে আসতে থাকে আপত্তি। বাধ্য হয়েই ইঁদুর দৌড়ে নামতে হয় পড়ুয়াদের। দৌড়ে ব্যর্থ হলেই দেখা দেয় হতাশা।

নীলাঞ্জনা ব¨্যােপাধ্যায় নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ‘বিদেশে পড়তে যাওয়া ২৪ বছরের এক তরুণ কোনও কারণে আশানুরূপ ফল না পাওয়ার হতাশায় আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন। সেই ভেবে তিনি তাঁর গাড়ি নিয়ে নির্জন পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে ঝাঁপটা দেননি। সেখানে দাঁড়িয়েই তিনি হেল্পলাইনে যোগাযোগ করেন। তাঁকে উদ্ধার করে স্থানীয় মানসিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে সেখান থেকে দেশে ফিরলে জানা যায়, তাঁর মা-বাবা দু’জনেই পেশায় অধ্যাপক। ওই তরুণ জানিয়েছেন, কখনও তাঁকে মা-বাবার কাছ থেকে আশানুরূপ ফলাফলের জন্য কিছু শুনতে হয়নি, কিন্তু তাঁদের ভাবভঙ্গির মধ্যে ছিল প্রবল বিরক্তি। সেই বিরক্তিই তাঁকে ভেতর থেকে নিঃশেষ করে দিত।

ছোটদের পড়াশুনোর ব্যাগ এখন বিরাট ভারি। তারাও ব্যস্ত সব কিছুকে সামলাতে। তাই ভুলেই গিয়েছে খেলাধুলো, তাইতো গানে-গানেও উঠে আসে ‘... ও ছেলেরা খেলা ফেলে শুধুই কেন পড়তে যাস।’

(মতামত লেখকের নিজস্ব)