শ্লীলতাহানি'র অভিযোগকে কেন্দ্র করে ব্যাপক উত্তেজনা হাওড়া জেলা হাসপাতাল চত্বরে
আরজি কর-কাণ্ডের মাঝেই এবার হাওড়া জেলা হাসপাতালে নাবালিকা রোগীর 'শ্লীলতাহানি'র অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শনিবার রাতে ব্যাপক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে হাসপাতাল চত্বরে। ঘটনা ঘিরে রাতে উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় জেলা হাসপাতাল চত্বরে। গ্রেফতার করা হয় অভিযুক্ত সিটি স্ক্যান বিভাগের অস্থায়ী কর্মী আমন রাজ'কে। অভিযোগ, শিবপুরের বাসিন্দা ১৩ বছরের ওই নাবালিকা গত ২৮ তারিখ নিউমোনিয়া নিয়ে ভর্তি হয়েছিল হাওড়া জেলা হাসপাতালে। শনিবার রাতে তাকে সিটি স্ক্যান করাতে নিয়ে যাওয়া হয়। হঠাৎ করেই ওই কিশোরী কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে এসে অন্য এক রোগীর আত্মীয়ের কাছে সাহায্য চায়। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা অন্যান্যরাও সেখানে দৌড়ে আসেন। এরপরেই খবর যায় এলাকায়। কিশোরীর পরিবার পরিজনেরা খবর পেয়ে পৌঁছে যান হাসপাতালে। প্রচুর মানুষ ছুটে আসেন হাসপাতালে। শুরু হয় বিক্ষোভ। অভিযুক্ত ওই সিটি স্ক্যান বিভাগের কর্মীকে মারধরেরও চেষ্টা করে উত্তেজিত মানুষ। হাসপাতালে পৌঁছায় হাওড়া থানার বিশাল পুলিশ বাহিনী। অভিযুক্ত ওই সিটি স্ক্যান বিভাগের অস্থায়ী কর্মীকে জনতার রোষ থেকে উদ্ধার করে পুলিশ হাওড়া থানায় নিয়ে যায়। পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযুক্তকে রাতেই গ্রেফতার করে পুলিশ। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও জেলা স্বাস্থ্য দফতরের তরফ থেকেও অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। রবিবার ধৃতকে হাওড়া আদালতে তোলা হয়। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তানিয়া চক্রবর্তী বলেন, ঘটনার সময় ২-৩ জন রোগী ছিল। সেখানে আমিও ছিলাম। সিটি স্ক্যান রুম থেকে ওই মেয়েটির চিৎকারের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। মনে করেছি ভয়ে চিৎকার করছিল। কিছুক্ষণ পরে মেয়েটি সিটি স্ক্যান রুম থেকে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে আমার বোনকে জড়িয়ে ধরে। সে আমাদের কাছে সাহায্য চায়। মেয়েটিকে কাঁদতে দেখে পরিবারের লোকেরা সেখানে এসে কারণ জিজ্ঞাসা করে। তখনই আসল সত্য সামনে আসে। মেয়েটির মুখে আঘাতের চিহ্ন ছিল। সেই মেয়েটি আরও জানায় যদি তার অভিভাবককে এই ঘটনার কথা বলে তাহলে তাকে ইনজেকশন দেবে বলে ভয় দেখানো হয়েছে। আরজি করের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই এমন ঘটনা সত্যিই লজ্জাজনক। এই বিষয়ে হাওড়া জেলা হাসপাতালের সুপার ডা: নারায়ণ চট্টোপাধ্যায় বলেন, যা ব্যবস্থা নেওয়ার তা নেওয়া হবে। যা হয়েছে তা পুলিশকে জানানো হয়েছে। পুলিশ আইনানুগভবে যা ব্যবস্থা নেওয়ার নেবে। হাওড়া হাসপাতালে সুরক্ষার ব্যবস্থা বাড়ানোর চেষ্টা করছি। গত ৩-৪ দিন ধরে সিটি স্ক্যান মেশিন খারাপ অবস্থায় ছিল। পুরনো মেশিন মাঝে মধ্যেই খারাপ হয়ে যায়। কবে তা ঠিক হয়েছে তা সঠিকভাবে জানা হয়নি। অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার দায়িত্ব পুলিশের। সরকারের গাইডলাইন অনুযায়ী হাসপাতালের নার্স, স্টাফেদের নিরাপত্তা দেওয়া হবে। হাওড়া জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ডা: কিশলয় দত্ত বলেন, অভিযুক্তের বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয়েছে। তাকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। এই হাসপাতালে সিটি স্ক্যান ডিপার্টমেন্ট চলছে পিপিপি মডেলে। ওদের শো-কজ করা হয়েছে। পুলিশ পুলিশের কাজ করছে। ঘটনার যথাযথ তদন্ত হবে। যদি দোষী প্রমাণিত হয় তাহলে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এদিকে, নাবালিকা রোগীর শ্লীলতাহানির ঘটনা নিয়ে রবিবার সকাল থেকেই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে হাওড়া জেলা হাসপাতাল চত্বরে। বাম, বিজেপি সহ বিরোধী দলের তরফ থেকে দফায় দফায় হাসপাতালে বিক্ষোভ হয়। হাওড়া জেলা হাসপাতালের সুপারের পদত্যাগের দাবি তুলে রবিবার সুপারের অফিস ঘেরাও করে বিক্ষোভ হয়। বাম যুব কর্মীরা দাবি তোলে এই ঘটনায় সুপারকে অপসারণ করতে হবে। হাসপাতালের সুপার ডা: নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়কে ঘিরেও বিক্ষোভ হয়। এদিন সকালে হাসপাতালের ইমারজেন্সি গেটের বাইরে বিক্ষোভ দেখায় বাম যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআই। বাম নেতা বিশিষ্ট আইনজীবী সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায় এদিন উপস্থিত ছিলেন বিক্ষোভ কর্মসূচিতে। বাম নেতৃত্বের অভিযোগ, হাওড়া জেলা হাসপাতালে ১৩ বছরের নাবালিকার সাথে যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। চিকিৎসারত অবস্থায় সিটি স্ক্যান করার সময় তার সঙ্গে যৌন নির্যাতন করা হয়েছে। অভিযুক্তকে আটক করা হয়েছে কিন্তু সরকারি হাসপাতালে এই ধরনের ঘটনায় নিরাপত্তা নেই। হাসপাতালে যদি এই ভয়ের পরিস্থিতি তৈরি হয় মহিলারা চিকিৎসা করাবেন কোথায় ? এই নিয়ে সুপারকে ঘেরাও করে বিক্ষোভ দেখায় বাম যুব নেতৃত্ব। এদিন হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়, দীপ্সিতা ধর সহ অন্যান্য বাম নেতৃত্ব। বাম নেত্রী দীপ্সিতা ধর বলেন, শনিবার রাতে হাসপাতালের সিটি স্ক্যান রুমে শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটে। বাচ্ছাটির হাতে কালসিটে দাগ ছিল। এছাড়া শরীরের একাধিক জায়গায় আঘাতের চিহ্ন ছিল। পুলিশ অভিযুক্তকে গ্রেফতার করেছে। যে ঘটনা ঘটেছে এর দায় পুলিশ, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেই নিতে হবে। হাসপাতালের সুপার আমাদের জানিয়েছেন এই ঘটনা তিনি জানেন না। তিনি এও জানিয়েছেন এমন ঘটনা আর হবেনা। হলে তিনি পদত্যাগ করবেন। বাম নেত্রী মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায় বলেন, রাজ্যের সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা শেষ হয়ে গিয়েছে। আমরা নিরাপত্তা চাই। যে বা যারা এমন ঘৃণ্য কাজ করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। আরজি কর এবং হাওড়া হাসপাতালের ঘটনা এই সময়ের মধ্যে ১৫টি এমন ঘটনা ঘটেছে। প্রশাসন, পুলিশ, সরকারকে যদি অপরাধীরা ভয় করত তাহলে অপরাধ কমত। আর সাধারণ মানুষ যদি ভয় পায় তারা এইভাবেই অত্যাচারিত হবে। এদিকে, হাওড়া জেলা হাসপাতালে নাবালিকা রোগীর শ্লীলতাহানির ঘটনায় হাওড়া জেলা হাসপাতালের নিউ বিল্ডিং এর সামনে এদিন বিক্ষোভ দেখান উমেশ রাই এর নেতৃত্বে বিজেপি কর্মীরা। ওই ঘটনার প্রতিবাদে বিজেপির তরফ থেকে দুপুরে হাসপাতালে বিক্ষোভ দেখানো হয়। বিজেপি নেতা সঞ্জয় সিং বলেন, রাজ্যে মহিলারা সুরক্ষিত নন। হাওড়া জেলা নাবালিকার শ্লীলতাহানি হয়েছে। প্রায় ১ ঘন্টা পর পুলিশ সেখানে আসে। এখানকার প্রশাসন মহিলাদের কোনও সুরক্ষা দিতে পারছে না। দোষ চাপাচ্ছে অন্যদের উপর।অন্যদিকে, হাওড়া হাসপাতালের ঘটনায় হাওড়ার পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানিয়ে এদিন বিকেলে হাওড়া থানা ঘেরাও কর্মসূচি নেয় বিজেপির মহিলা মোর্চা। ওই কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ, বিজেপির রাজ্য মহিলা মোর্চার সভানেত্রী ফাল্গুনী পাত্র সহ অন্যান্য রাজ্য নেতৃত্ব। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন হাওড়া জেলা সদরের সভাপতি রামপ্রসাদ ভট্টাচার্য, হাওড়া জেলা সদর মহিলা মোর্চার সভানেত্রী পৌলমী আদক। হাওড়া থানার সামনে রাজ্যের পুলিশ মন্ত্রীকে ধিক্কার জানিয়ে স্লোগান দেন তারা। দিলীপ ঘোষ বলেন, আজ সকালে প্রাতঃভ্রমণের সময় ব্যবসায়ীর উপর গুলি চালনা এবং কিশোরীর উপর শ্লীলতাহানির ঘটনা জানতে পারি। এটা সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ১৪ বছরে ৪৮ হাজার এমন ঘটনা ঘটেছে। এইরকম ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কখনও ফাঁসি কখনও ফাস্ট ট্রাক কোর্টে মামলার কথা বলছেন। কিন্তু না কোনও তথ্য দিচ্ছেন, না কাউকে গ্রেফতার করতে দিচ্ছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যেয়র সরকার থাকলে এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে।