তারাপীঠের ২০০বছরের বেশি ও ইতিহাস
সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়: তারাপীঠের বর্তমান মন্দিরের ইতিহাস প্রায় দুশো বছরের বেশি হলেও তারাপীঠের ইতিহাস কিন্তু হাজার দেড়হাজার বছরেরও অধিক। তার ইতিহাস প্রাচীন, আবছায়া, অস্পষ্ট এক অতীতের মধ্যে মিশে আছে। একদিকে ইতিহাস, দলিল-দস্তাবেজ আর অন্যদিকে পুরাণ ও লোককথা। সব মিলেই তারাপীঠের মন্দির এবং তারামায়ের কাহিনী এক অন্য স্থান দখল করেছে ।
তারাপীঠের বর্তমান মন্দির মল্লারপুরের জমিদার স্থাপন করলেনও গল্পের শুরু জয়দত্ত সদাগরের কথা হতে। আজও মুখে মুখে চলে আসছে তাঁর কাহিনী। আজ থেকে প্রায় আটশো বছর আগের ঘটনা। তিনি ছিলেন বীরভূমের রত্নাগড় নিবাসী। একবার তিনি বাণিজ্যে প্রভূত সম্পদ, অর্থ লাভ করে বাড়ি ফিরছিলেন। চলার পথে অসুস্থতায় মৃত্যু হল তাঁর প্রাণাধিক পুত্রের। বাড়ি ফিরেই ছেলের অন্ত্যেষ্টি করবেন স্থির করে তিনি মাঝিদের বললেন, পুত্রের দেহটাকে ভালো করে ঘি মাখিয়ে রাখতে। তাতে পচন ধরবে না। এদিকে সন্ধ্যা নেমেছে। রাত্রিটা তাই পথেই বিশ্রাম নিতে হবে। চলতে চলতে থামলেন এক বিশাল জঙ্গলের পাশে। স্থানটির নাম চণ্ডীপুর।
রাতে ঘুম নেই জয়দত্তের। মৃত ছেলের দেহ আঁকড়ে রাত জাগছেন তিনি। সেই সময় তারামা এক কুমারী মেয়ের রূপ ধরে নৌকার কাছে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর কালো রূপে যেন আলো ছিটকে পড়ছে। রাত্তির আকাশজুড়ে অপূর্ব এক জ্যোতি। অপূর্ব সুন্দরী সেই মেয়েটি জয়দত্তকে জিজ্ঞাসা করলেন,‘ও বাছা, এত নৌকা ভরে কী নিয়ে চলেছো গো?’ পুত্রশোকে জয়দত্তের মন ভারাক্রান্ত ছিল। তাই তিনি রাগত স্বরে মেয়েটিকে বললেন, ‘ছাই আছে’। সে কথা শুনে মেয়েটি ‘আচ্ছা’ বলে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে জয়দত্ত দেখলেন তাঁর নৌকার সব বাণিজ্যসামগ্রী, অর্থ ছাইতে পরিণত হয়েছে। পরদিন সকালে মাঝিরা রান্নায় বসল। খেয়েদেয়ে নৌকা নিয়ে যাত্রা করতে হবে। কাটা শোল মাছ কাছেই এক কুণ্ডের জলে ধুতে গেল তারা। কী আশ্চর্য! জলের স্পর্শ পেয়ে মাছটি জ্যান্ত হয়ে সাঁতরে চলে গেল। মাঝিরা দৌড়ে এসে জয়দত্তকে সব কথা জানাল। জয়দত্তের মনে পড়ল আগের রাতের কথা। সেই মেয়েটির কথা। তখন পুত্রশোকে কাতর হয়ে বারবার তিনি বলতে লাগলেন, ’মাগো দেখা দে। কে তুই মাগো আমাকে এমন পরীক্ষা করে গেলি। আমাকে ক্ষমা কর মা। আমার সন্তানকে বাঁচিয়ে দে।’
সেদিন রাতেই স্বপ্নের মধ্যে ফিরে এলেন সেই মেয়েটি। তাঁকে দেখে জয়দত্ত বললেন, ‘পুত্র মলো ধন ছাই কিসের লাগিয়া।’ কুমারী মেয়ে রূপী তারা মা তাঁকে বললেন, ‘ভবানী বলেন সাধু না হও কাতর /প্রাতে উঠি পাবে ধন নৌকার ভিতর।’ সেই সঙ্গে তারা মা তাঁকে বললেন, কুণ্ডের জল ছেলের গায়ে ছড়ালেই সে বেঁচে উঠবে। সকালে জয়দত্ত তাঁর হারানো সম্পদ ফিরে পেলেন এবং বশিষ্ঠকুণ্ডের জল ছেলের গায়ে ছেটাতেই ছেলে ‘তারা তারা’ বলে বেঁচে উঠল। ছেলের মুখে তারা নাম শুনে বিস্মিত জয়দত্ত বুঝতে পারলেন দেবী তারার অলৌকিক কৃপার কথা। পুত্রকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে তিনি সারাদিন বসে তারা মায়ের জপ করতে লাগলেন। রাতে আবার দেবী তাঁকে স্বপ্নে দর্শন দিলেন। তাঁকে আদেশ করে বললেন, ‘এই জঙ্গলের মধ্যে একটা শ্বেতশিমুল গাছের নীচে একটা শিলাবিগ্রহ রয়েছে। সেই বিগ্রহ একটা মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করে তার পুজোর ব্যবস্থা করবি। আমি হলাম উগ্রতারা। জঙ্গলের মধ্যে শ্মশানে আমার বাস।’ পরদিন সকালে লোকজন নিয়ে সেই বিশাল জঙ্গলে খুঁজে খুঁজে শ্বেতশিমুল গাছের নীচ থেকে শিলাবিগ্রহ আবিষ্কার করলেন জয়দত্ত। কাছেই পেলেন চন্দ্রচূড় শিবের মূর্তি। বশিষ্ঠকুণ্ড বা জীবিতকুণ্ডের সামনে তাড়াতাড়ি মন্দির নির্মাণ করে সেই শিলামূর্তি ও চন্দ্রচূড় শিবের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করলেন তিনি। শুধু তো মন্দির প্রতিষ্ঠা করলেই হবে না। তার নিত্যপূজাও দরকার। তাই জয়দত্ত কাছেই মহুলা গ্রামের এক ব্রাহ্মণকে নিত্যপূজার দায়িত্ব দিয়ে বিদায় নেন।
এভাবেই তারাপীঠে প্রথম মন্দির নির্মাণ হয়। শুরু হয় মায়ের ভোগরাগ। কিন্তু তার আগে থেকেই এই স্থান তারামায়ের বিরাজক্ষেত্র। পুরাণেও এই স্থানের বর্ণনা মেলে। এখানকার সিদ্ধ শ্মশানে বহু সাধুসন্ত সিদ্ধিলাভ করেছেন। পুরাণের সেই দক্ষযজ্ঞের কাহিনী আমরা জানি। পতিনিন্দা সহ্য করতে না পেরে দক্ষের যজ্ঞাগারে আত্মাহুতি দেন সতী। সেকথা শুনে শিব সতীর দেহ নিয়ে সবকিছু লণ্ডভণ্ড করতে শুরু করেন। শিবকে থামাতে বিষ্ণু তাঁর চক্র দিয়ে সতীর দেহ খণ্ডবিখণ্ড করেন। সেই দেহখণ্ডগুলি বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে এবং সেখানে এক একটি সতীপীঠ গড়ে ওঠে। সতীর ঊর্ধ্ব নয়নতারা বা প্রজ্ঞানয়ন পড়েছিল তারাপীঠের সেই শ্বেতশিমূল গাছের নীচে। পুরাণের কাহিনী থেকে আরও জানা যায়, সতীহারা শিব দেবীকে কামনা করে এখানে এসে সাধনা করেন। তিন লক্ষ জপ করেছিলেন। তাঁর সাধনায় তুষ্ট হয়ে তারা বলেছিলেন, তিনি আবার উমারূপে তাঁর কাছে স্ত্রী রূপে যাবেন। আরও জানা যায়, মহামুনি বশিষ্ঠ বিষ্ণুর দ্বারা আদিষ্ট হয়ে এখানে এসে সাধনা করেছিলেন। সেই শ্বেতশিমুল, গাছের নীচে বসে তিনিও তিন লক্ষ তারা জপ করেছিলেন। তিনি সাধনলাভ করেছিলেন আশ্বিন মাসের কোজাগরী শুক্লা চতুর্দশীতে। আরও আশ্চর্যের ঘটনা হল, জয়দত্ত মন্দির প্রতিষ্ঠা করে প্রথম যেদিন দেবীর পুজো করেছিলেন, সেদিনটাও ছিল কোজাগরী শুক্লা চতুর্দশী। আজও এই বিশেষ দিনে তারামায়ের পুজো ধুমধাম করে হয়।
কেন এখানকার দেবী নাম তারা হল, তাই নিয়েও আছে পুরাণের এক কাহিনি। সমুদ্রমন্থনে ওঠা বিষ পান করে শিব হয়ে উঠলেন নীলকণ্ঠ। বিষে জর্জরিত তিনি। সেই যন্ত্রণা থেকে কীভাবে শিব মুক্তি পাবেন। সব দেবতা ‘দেবী তারার’ কাছে গিয়ে বললেন, শিবকে গরলমুক্ত করতে। ‘দেবী তারা’ তখন শিবকে আপন সন্তানের মতো কোলে নিয়ে আপন স্তন্য থেকে অমৃত পান করাতে লাগলেন। সেই অমৃত পান করে শিবের বিষজ্বালা দূর হল। সেই থেকে দেবীর নাম হল তারিণী। তিনি শিবকে তারণ করেছেন। এই বিশ্বকেও তিনি তারণ করেন। সেই তারিণী থেকেই তারা নামের সৃষ্টি।
পুরাণ থেকে মধ্যযুগ হয়ে ফেরা যাক আধুনিক বাস্তবের ইতিহাসে। জয়দত্তের তৈরি করা মন্দির একদিন ক্রমেই জীর্ণরূপ ধারণ করল। তখন সেই মন্দিরকে নতুনভাবে নির্মাণ করতে এগিয়ে এলেন বীরভূমের এড়োল গ্রামের রামজীবন রায়চৌধুরী। সেটি হল তারাপীঠের মন্দিরের দ্বিতীয় নির্মাণ। সেটা ছিল আনুমানিক ১৭৪৩ খ্রিস্টাব্দ। রামজীবন ছিলেন তারাপীঠের এলাকা ওই পুরো এলাকার পত্তনিদার। তারাপীঠের মন্দিরের ভগ্নদশা দেখে ভক্ত রামজীবনের মন খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু মন্দির সংস্কারের মতো অর্থ তাঁর ছিল না। তাই প্রজাদের কাছ থেকে তোলা খাজনার টাকায় তিনি আবার নতুন করে মন্দির গড়ে দিলেন। এর ফলে তিনি খাজনার টাকা তৎকালীন বাংলার নবাব আলিবর্দি খাঁকে দিতে পারলেন না। এর বিচার করার জন্য তাঁকে পেয়াদারা মুর্শিদাবাদে ধরে নিয়ে যায়। তিনি বলেন, খাজনার টাকা দিয়ে তিনি তারামায়ের মন্দির নির্মাণ করেছেন। কোনওরকম তছরুপ তিনি করেননি। নবাব একথার সত্যতা বিচারের জন্য লোক পাঠালেন। তাঁরা ফিরে এসে নবাবকে জানালেন, রামজীবন সত্য কথাই বলেছেন। তাঁর সত্যবাদিতায় খুশি হয়ে নবাব সব খাজনা মকুব করে রামজীবনকে রেহাই দিলেন।
সময় পেরিয়ে যায়। দ্বারকা নদী দিয়ে গড়িয়ে যায় কত জল। কত সাধক এখানে আসেন আবার সিদ্ধিলাভ করে চলে যান। একদিন এলেন সাধক কমলাকান্ত। এসে দেখেন জীর্ণ তারামায়ের মন্দির। সেই ভাঙা মন্দিরের সামনে বসে তিনি মাকে শোনালেন একের পর এক গান। আর তাঁর দু’চোখ বেয়ে নেমে এল জলের ধারা।
মন্দিরের সেই ভগ্নদশা দেখে কেঁদে ফেলেছিলেন জগন্নাথ রায়ও। তিনি ছিলেন মল্লারপুরের জমিদার। মায়ের মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে মানত করেছিলেন,‘মাগো আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হলে তোমার নতুন মন্দির গড়ে দেব মা।’ তারামা তাঁর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেছিলেন। তারপরই জগন্নাথ রায় তারামায়ের মন্দির সংস্কার করে দেন। সেটা ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের ১৫ এপ্রিল। মন্দির নির্মাণের পাশাপাশি নতুন করে তৈরি করলেন চন্দ্রচূড় শিবের মন্দির, মায়ের বিরামখানা, ভোগঘর, ভাণ্ডারঘর প্রভৃতি।
সেই হিসেবেই বলা হচ্ছে, তারাপীঠের মন্দিরের দু’শো বছর পূর্ণ হল। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, কথাটা আংশিক সত্য। কেননা তারাপীঠের মন্দিরের ইতিহাসকে দুশো বছরের মধ্যে আটকানো যায় না। তার ইতিহাস প্রাচীন, আবছায়া, অস্পষ্ট এক অতীতের মধ্যে মিশে আছে। একদিকে পুরাণ আর একদিকে ইতিহাস। একদিকে লোককথা, অন্যদিকে দলিল। সব মিলেই তারাপীঠের মন্দির এবং তারামায়ের কাহিনী একাকার হয়ে গিয়েছে। ইতিহাসকার শুধু প্রমাণ খুঁজতে গেলে অতীতের আবছায়া কাহিনীগুলোকে অস্বীকার করতে হয়। কিন্তু তা সম্ভব নয়। যুগ যুগ ধরে ভক্তপ্রাণ বাঙালি হৃদয় সেসব আত্মসাৎ করে বসে আছে। তাই আপাতভাবে মন্দিরের দু’শো বছর কথাটা আংশিক সত্য। ইতিহাসকার থাকুন ইতিহাস নিয়ে, ভক্ত থাকুন তাঁর আপন বিশ্বাসে। কেননা এখানে ভক্তিই শেষ কথা। ‘তারাপীঠং মহাপীঠং গন্তব্যং যত্নতঃ সদা।’