অদৃশ্য নদীর অজানা রহস্য
আসলে এর পিছনে রয়েছে একটি বৈজ্ঞানিক কারণ। আবার কেউ কেউ একে অভিশাপ বলেও মনে করেন। এমনকি এই নদীর নাম ঋকবেদেও রয়েছে। শোনা যায়, সরস্বতী নদী মাটির নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। আর কেশব প্রয়াগ হল, গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী নদীর সঙ্গমস্থল। ইসরোর এক গবেষণা থেকে জানা গিয়েছে, আজও সরস্বতী নদী হরিয়ানা, পঞ্জাব এবং রাজস্থানের মধ্যে দিয়ে ভূগর্ভে প্রবাহিত হয়।
চিরশ্রী দাস: ভারত এক প্রাচীন দেশ। এই দেশের ইতিহাস যেমন সমৃদ্ধ, তেমনই সজীব এখানকার সংস্কৃতি। দেশের নদ-নদীর ইতিহাসও অনেক প্রাচীন। সনাতন ধর্মে প্রকৃতিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হত। পর্বত, গাছ, পশু, বিদ্যুৎ, বাতাস সবকিছুকেই সম্মান জানানো হত। তালিকায় আছে নদীও। নদীর প্রাকৃতিক গুরুত্ব অপরিহার্য। ভারতীয় সংস্কৃতিতে, নদীকে দেবী হিসাবে পুজো করা হয়। ভারতকে ‘নদীমাতৃক’ দেশও বলা হয়।
বর্তমানে ভারতে প্রায় ২০০টি নদী রয়েছে। আজ এমন এক নদীর কথা বলতে যাচ্ছি, যার নাম আমরা বইয়ের পাতায় অনেকবার দেখেছি, কিন্তু বাস্তব জীবনে এটিকে প্রবাহিত দেখার সুযোগ পাইনি বললেই চলে। কারণ নদীটি এখন শুকিয়ে গেছে। ভারতের এই নদীকে ‘অদৃশ্য নদী’ বলা হয়। তাহলে চলুন দেশের এই অদৃশ্য নদী সম্পর্কে জেনে নিই।
কথা হচ্ছে পৌরাণিক নদী সরস্বতীকে নিয়ে। সরস্বতী নদীর নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন? ভারতের কোন অংশ দিয়ে এই নদী প্রবাহিত হয়, জানেন? কিংবা আপনি কখনও নিজের চোখে এই নদীর অস্তিত্ব দেখেছেন? এসব প্রশ্নের উত্তর যদি আপনার কাছে না থাকে, তাহলে এই নিবন্ধটি রইল আপনার জন্য। আসলে এর পিছনে রয়েছে একটি বৈজ্ঞানিক কারণ। আবার কেউ কেউ একে অভিশাপ বলেও মনে করেন। এমনকি এই নদীর নাম ঋকবেদেও রয়েছে। ইতিহাসে বলা আছে, এই নদীর জল পান করে ঋষিরা বেদ রচনা করেছিলেন এবং বৈদিক জ্ঞানের প্রসার করেছিলেন। আজ পর্যন্ত এই নদীকে কেউ বয়ে যেতে দেখেনি। এর পিছনেও রয়েছে একটি বড় কারণ। কথিত আছে যে, এই নদী হিমাচলের সিরমাউর এলাকার পাহাড়ি অংশ থেকে উৎপন্ন হয়ে আম্বালা, কুরুক্ষেত্র, কাইথাল এবং পাটিয়ালার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সিরসার দৃষ্টিবতী নদীতে মিলিত হয়েছে। আজও পৌরাণিক কাহিনিতে এই নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু বাস্তবে এই নদী পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। যদিও হাজার বছর আগে এই নদীটি প্রবাহিত হত। কিন্তু অভিশাপের কারণে এটি শুকিয়ে গিয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। বর্তমানে এর অস্তিত্ব শুধু রয়ে গিয়েছে নামে মাত্র।
রামায়ণ ও মহাভারতের মত ধর্মগ্রন্থেও সরস্বতী নদীর বর্ণনা রয়েছে। শোনা যায়, সরস্বতী নদী মাটির নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। আর কেশব প্রয়াগ হল, গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী নদীর সঙ্গমস্থল। এখানে সরস্বতী নদী ধরিত্রীর ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়। অর্থাৎ পুরাণ মতে সরস্বতী অন্তঃসলিলা এবং শুধুমাত্র প্রয়াগের সঙ্গমেই দৃশ্যমান। সরস্বতীকে বৈদিক সভ্যতার বৃহত্তম এবং প্রধান নদী হিসাবে বিবেচনা করা হত।
ইসরোর এক গবেষণা থেকে জানা গিয়েছে, আজও সরস্বতী নদী হরিয়ানা, পঞ্জাব এবং রাজস্থানের মধ্যে দিয়ে ভূগর্ভে প্রবাহিত হয়। ২০০২ সালে ‘ডাউন টু আর্থ’-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গিয়েছে, হরপ্পা সভ্যতার সময় এই নদীটির অস্তিত্ব ছিল। হরপ্পা সভ্যতার বেশ কিছু অংশ গড়ে উঠেছিল এই নদীর তীরে। এছাড়া মহাভারতের বেশ কিছু অংশে এমন একটি নদীর উল্লেখ রয়েছে যা হরিয়ানার একটি শহরে, বর্তমানে সিরসা নামে পরিচিত, পরবর্তীকালে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। ভৌগোলিক, ইতিহাস ও প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা থেকে জানা গিয়েছে, রাজস্থান সবসময় শুষ্ক ছিল না। এখানে সবুজ ঘেরা অঞ্চলও ছিল এবং এখান দিয়ে নদীও বইত। তাছাড়া এই অঞ্চলের চারপাশে মহেঞ্জোদারো এবং হরপ্পা সভ্যতাও গড়ে উঠেছিল।
পাশাপাশি জানা গিয়েছে হুগলির ত্রিবেণীর গঙ্গা থেকে বেরিয়ে ৭৭ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে হাওড়ার সাঁকরাইলে গিয়ে সরস্বতী ফের ওই নদীতেই মিশেছে। কিন্তু অনেক জায়গাতেই নদীটির কার্যত কোনও অস্তিত্ব নেই। ইতিহাস বলে, বহু শতাব্দী আগে এই নদী ছিল অন্যতম বাণিজ্যপথ। সরস্বতীর দু’ধারে অনেক মন্দির আছে। বণিকেরাই বাণিজ্য করতে যাওয়ার সময় ওই সব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন, এমনটাই ধারণা। সেই নদী এখনও মুছে যায়নি।
‘চুরি’ হয়ে গিয়েছে ইতিহাসের সরস্বতী। গঙ্গা ছাড়াও আর যে নদী একসময়ে দুই জেলার সমৃদ্ধির কারণ হয়ে উঠেছিল, এখন সেই সরস্বতী গতিহারা। কচুরিপানায় আবদ্ধ। কোথাও নদীর অংশ দখল করে দাঁড়িয়ে কংক্রিটের নির্মাণ, কোথাও তার ‘ডাস্টবিন’-এর চেহারা। যেখানে জলের দেখা মেলে, রং নিকষ কালো।